শ্রম ও শিল্প আইন কি?

শিল্প উৎপাদনের বাহন৷ উৎপাদন ছাড়া ভোগ কার্যত সম্ভব নয়৷ কৃষিকার্য পশু পালন শিকার ইত্যাদি পেশা এক সময়ে জনপ্রিয় থাকলেও আধুনিক বিশ্বে শিল্পই হল মানুষের উপজীবিকার প্রধান অবলম্বন৷ শিল্প নির্ভর দেশগুলোই এখন উন্নয়নের সর্বোচ্চ শিখরে অবস্থান করছে৷ 
শিল্প কারখানা
শিল্প কারখানা

তাই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শিল্প গড়ে উঠেছে নানা ধরনের৷ ক্ষুদ্র কুটিরশিল্প হতে শুরু করে উচ্চ প্রযুক্তিসম্পন্ন ভারী শিল্প সকল দেশেই কমবেশি লক্ষ করা যায়৷ এ সব শিল্পের সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য সরকার বিভিন্ন নিয়মনীতি প্রবর্তন করেছেন যাকে শ্রম ও শিল্প আইন বলে৷

শ্রম ও শিল্প আইনের সংজ্ঞা (Definition of Labour and industrial law) কি?

শিল্প আইনের কোন নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই৷ সাধারণত কারখানা বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান  ও আইন প্রবর্তিত হয়েছে তাকেই শ্রম ও শিল্প আইন বল হয়৷ 

অতএব শিল্পকারখানার সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের স্বার্থরক্ষা করে সকল পক্ষের সম্পর্কের উন্নয়ন তথা শিল্পকারখানার বিকাশের লক্ষ্যে দেশের আইন পরিষদ বা পার্লামেন্ট যে সকল বিধিবিধান নির্দিষ্ট ও প্রবর্তন করে তাকেই শ্রম ও শিল্প আইন বলে৷

শ্রম ও শিল্প আইনের উদ্দেশ্য?

মানুষ যেন খেয়ার খুশিমতো আচরণ না করে বরং বিধিবিধানের আওতায় শৃঙ্খলাপূর্ণ আচরণ প্রদর্শনের মাধ্যমে সকলের জন্য কল্যাণ ও শান্তি শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে পারে এ উদ্দেশ্যই আইন প্রণয়ন করা হয়৷ নিম্নে বিভিন্ন দিক বিবেচনায় শিল্প আইনের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা হলঃ

শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষা (Maintenance of workers interst)

শিল্প প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত শ্রমিক কর্মীদের স্বার্থ রক্ষার জন্যই মূলত শ্রম ও শিল্প আইনের উদ্ভব ঘটেছে৷ মালিকপক্ষ আর্থিক সামর্থ্যের জোরে শ্রমিক কর্মীদের সাথে যেন অমানবিক আচরণ প্রদর্শন করতে না পারে এবং শ্রমিক কর্মীদের স্বার্থ রক্ষা করে শিল্পকারখানা পরিচালনা করতে উদ্বত হয় এজন্য বিভিন্ন ধরনের আইন পাস করা হয়েছে৷

শিল্পশান্তি বজায় রাখা (Maintenance of industrial peace)

শিল্পশান্তি বজায় রাখা শিল্প আইনের একটি অন্যতম উদ্দেশ্য৷ শিল্পপ্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের স্বার্থে শ্রমিক ও মালিকপক্ষের মধ্যে কার্যকর সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা ও বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয়ে থাকে৷ 

উভয়পক্ষ যেন আইনে বর্ণিত তাদের অধিকার ও দায়দায়িত্বের সীমা সম্পর্কে জ্ঞাত থেকে তাদের দায়িত্ব পালন করে এবং প্রতিষ্ঠানে কোন সমস্যা হলে তা আইনানুগভাবে মোকাবিলা করতে সচেষ্ট হর এজন্য শ্রম ও শিল্প আইন প্রণয়ন করা হয়েছে৷

শ্রমিক কর্মীদের সামাজিক নিরাপত্তা বিধান (Maintenance of social security of workmens)

শ্রমিক মালিক সম্পর্কের উন্নয়ন নির্ভর আইনের প্রতি উভয় পক্ষের শ্রদ্ধাবোধ এবং যথাযথভাবে নিয়ম ও বিধিবিধান অনুশীলনের উপর৷ 

আইনে সকল পক্ষের যে সকল অধিকার দায়িত্ব ও কর্তব্যের উল্লেখ রয়েছে তা যদি সবাই মনে চলে তবে কখনই প্রতিষ্ঠানের বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে না৷

শ্রম ও শিল্প আইনের আওতা (Scope of industrial law)

শিল্প আইন হল দেশের শিল্পসংক্রান্ত বিভিন্ন আইনের সমষ্টি৷ শিল্পের আওতা বা পরিধি বর্তমানে এতটাই বিস্তৃতি লাভ করেছে যে প্রাকৃতিক সম্পদকে মানুষের ব্যবহার উপযোগী পণ্য প্রস্তুতে ছোট বড় নানা ধরনের শিল্পই এর সাথে সম্পৃক্ত থাকে৷ 
শ্রমিক
শ্রমিক

এ সকল শিল্পের সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য বিভিন্ন ধরনের আইন পাস করা হয়েছে৷ তাই এর আওতা বা পরিধিও বেড়েছে ব্যাপকভাবে৷ নিম্নে এর আওতাধীন বিভিন্ন আইন উল্লেখ করা হলঃ

কাজের ধরণ সম্পর্কিত আইন?

  • কারখানা আইন ১৯৬৫
  • খনি আইন ১৯২৩
  • খনিশ্রমিক আইন ১৯৩৪

মজুরি সম্পর্কিত আইন?

  • মজুরি পরিশোধ আইন ১৯৩৬
  • সর্বনিম্ন মজুরি অধ্যাদেশ ১৯৬১
  • প্রভিডেন্ট ফান্ড আইন ১৯২৫

শিল্প সম্পর্কে বিষয়ক আইন?

  • শিল্প সম্পর্কে অধ্যাদেশ ১৯৬৯
  • শিল্প সম্পর্কে অধ্যাদেশ ১৯৮৯

সামাজিক নিরাপত্তা সম্পর্কিত আইন?

  • শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ আইন ১৯২৩
  • নিয়োগকর্তার দায় আইন ১৯৩৮
  • শ্রমিকদের নিরাপত্তা আইন ১৯৩৪

চাকরির শর্ত নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত আইন?

  • শ্রমিক নিয়োগ আইন ১৯৬৫
  • দোকান ও প্রতিষ্ঠান আইন ১৯৬৫

শিশুশ্রমিক সংশ্লিষ্ট আইন?

  • শিশু নিয়োগ আইন ১৯৩৮
  • শিশু (শ্রম বন্ধ) আইন ১৯৩০

শ্রম ও শিল্প আইনের গুরুত্ব?

শ্রম ও শিল্প আইন শুধু শিল্পের সাথে সম্পর্কিত মালিক ও শ্রমিক শ্রেণির উন্নয়নেই ভূমিকা রাখে না সামগ্রিকভাবে একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করে৷ শিল্প আইনের গুরুত্ব নিম্নে আলোচনা করা হলঃ

শ্রমিকদের নিরাপত্তা বিধান

শ্রমিকসংঘ করার সুযোগ সৃষ্টি চাকরি হতে অন্যায়ভাবে বহিষ্কার বা ছাঁটাইয়ে বাধাদান কর্মস্থলে দুর্ঘটনার জন্য ক্ষতিপূরণ প্রদান কার্যক্ষেত্রে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ ইত্যাদি বিষয় শ্রম ও শিল্প আইনে নির্দিষ্ট করে শ্রমিক কর্মীদের কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা অনেকটাই নিশ্চিত করা হয়েছে৷

শ্রমিক কর্মীদের সচেতনতা বৃদ্ধি

শ্রম ও শিল্প আইন শুধু মালিকপক্ষের নিকট হতে শ্রমিক কর্মীদের অধিকার প্রাপ্তিই নিশ্চিত করেনি বরং তাদেরকে যথেষ্ট অধিকার সচেতন ও কর্মস্থলে সংঘবদ্ধ করেছে৷

সু সম্পর্ক স্থাপনে

শ্রমিক ও মালিক উভয়পক্ষ শ্রম ও শিল্প আইনের মাধ্যমে তাদের স্ব স্ব অধিকার দায়দায়িত্ব ক্ষমতা এবং কর্তব্য সস্পর্কে অবহিত থাকায় বিরোধ কম হয়৷ কোন কারণে শিল্প বিরোধ সংঘঠিত হলে তা শ্রম ও শিল্প আইনের আওতায় নিষ্পত্তি করে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটায়৷

দেশের অর্থনেতিক উন্নয়ন সাধনে

শ্রম ও শিল্প আইন শ্রম ব্যবস্থাপনা সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে উৎপাদনের ধরা অব্যহত রাখে৷ শিল্পপ্রতিষ্ঠানে উৎপাদন দেশে কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক উন্নতিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে৷

শ্রমিকদের স্বাস্থ্যরক্ষা কল্যাণ নিশ্চিতকরণ

শ্রমিক কর্মীদের সাধারণভাবে যেই পরিবেশে কাজ করতে বাধ্য করা হয় অনেকক্ষেত্রেই তা তাদের স্বাস্থ্যহানির কারণ হয়ে থাকে৷ 

শ্রম ও শিল্প আইনে বিভিন্ন বিধান সন্নিবেশিত করে কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের স্বাস্থ্যরক্ষা ও কল্যাণ নিশ্চিতকরণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে যা সমাজের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশকে মারাত্মক বিপদের হাত হাতে রক্ষা করেছে৷

সামাজিক নিরাপত্তা বিধান

বর্তমান শিল্পনির্ভর বিশ্ব শ্রমিক শ্রেণি যে কোন সমাজেরই একটি উল্লেখযোগ্য অংশ৷ এই শ্রেণির উপর আবার নির্ভর করে তাদের পরিবার পরিজনসহ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ৷ 

শ্রম ও শিল্প আইনে চাকরির স্থায়িত্বের ব্যবস্থা ন্যূনতম মজুরি নিশ্চিতকরণ যথাসময়ে মজুরি প্রাপ্তি প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ দান পেনশন প্রভিডেন্ট ফান্ড গ্রাচ্যুইটি ইত্যাদির ব্যবস্থা করে সামাজিক নিরাপত্তা বিধানের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে৷

শ্রমিক কর্মীদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা

শ্রম ও শিল্প আইন শ্রমিক কর্মীদেরকে তাদের মর্যাদার আসনেও প্রতিষ্ঠা করেছে৷ প্রতিষ্ঠানে শ্রমিক কর্মীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে দরকষাকষির সুযোগও তারা লাভ করেছে৷ মালিকপক্ষের সাথে একই টেবিলে বসে আলাপ আলোচনার সুযোগ করে দিয়েছে শ্রম ও শিল্প আইন।
Textile BD

Founder and Editor of Textile BD. He is a Textile Blogger & Entrepreneur. He is working as a textile job in Bangladeshi companies.

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন